ষোলটাকা ইউনিয়ন অবিভক্ত নদীয়া জেলার অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটি ইউনিয়ন। ষোলটাকা ইউনিয়ন অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের অন্যতম ইউনিয়ন ছিল। ষোলটাকা ইউনিয়নের ভাষা ও লোক সংস্কৃতির কিছু উদাহরণ নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ
ষোলটাকা ইউনিয়নেরলোকসংস্কৃতিঃ
ষোলটাকা ইউনিয়ন নদীয়া জেলার প্রাচীন জনপদ হওয়ায় এখানে লোকসংস্কৃতি বা গ্রামীণ সংস্কৃতি বিভিন্নভাবে চর্চার মাধ্যমে ঐতিহ্যে রূপান্তরিত হয়েছিল। বাঙালীর সমাজ জীবনে নানা উৎসব আয়োজনে নানা ধরণের গীত, কবিগান, ভাবগান, পুঁথিপাঠ, মেঠো গান, মানসার গান, ভাসান গান, ছেলে নাচানো গান, মানিকপীরের গান, বোলান গান, অষ্টগান, গাজীর গীত ও কৃষ্ণগান সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। লোক সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রভাব ও এক শ্রেণীর প্রভাবশালী সমাজপতিদের বিদ্রুপান্তক দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ অন্তরায় সৃষ্টি করলেও বহুকাল ধরেই লোকসংস্কৃতি ষোলটাকা ইউনিয়নের সমাজজীবনে নানাভাবে বিদ্যমান রয়েছে।
১) বাউলগীতিঃ
বৃহত্তর কুষ্টিয়ার অঞ্চল হিসেবে ষোলটাকা ইউনিয়নে কুষ্টিয়ার বাউল সম্রাট লালন শাহের প্রভাবে শত শত বাউল অনুরাগী ও বাউল শিল্পীর সৃষ্টি হয়েছে। তাঁরা মানবধর্মের কথা বলেন এবং দেহতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন। বাউলগণ দেহতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও মরমী গানের মাধ্যমে মানুষকে অতিন্দ্রীয়লোকে বিচরণ করাতে সক্ষম হন। ষোলটাকা ইউনিয়নে এখনো শত শত বাউল অনুরাগী তাঁদের ব্যক্তিজীবনে বাউল সঙ্গীত ও লালনের জীবনাদর্শ চর্চা অব্যাহত রেখেছেন।
২)পাগল আব্দুল গনী শাহ এর আখড়াঃ
ষোলটাকা ইউনিয়নে মুন্দাইল বিলের পশ্চিম তীরে জুগিরগোফা গ্রামে জন্ম নেয়া পাগল আব্দুল গনী শাহ একজন বিখ্যাত বাউল সাধক। প্রতি বছর ১৬ই মাঘ , এখানে দেশের বাউল ফকিরগণের সমাবেশ হয়। লালন পরবর্তী সময়ে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে লালনের আদর্শকে হৃদয় পটে ধারণ করে যে সকল সাধক সাধনায় দিক্ষিত হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম পাগল আব্দুল গনী শাহ। জীবনের শুরু থেকে অদ্যবধী অসংখ্য ভাব সঙ্গীত রচনা করেছেন। তার সঙ্গীতের অন্যতম বৈশিষ্ঠ আল্লা এবং আল্লার রাসুলের প্রতি বিশেষ অনুগত্য প্রকাশ। তার হৃদয় ও সাধনা নিঃসৃত এই গান এতদ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ব্যাপক ভাবে সমাদৃত। তার উল্লেখ্য যোগ্য গান গুলীর কিছু অংশ নিম্নেঃ
কি ফুল ফুটিলরে জগত মাতিলরে, মক্কা মদিনার পরে।
ভাব সঙ্গীতে লালন ফকির মজাইলো দুই কুল,
এক তারা বাজাইয়া আমায় কইরাছে পাগল।
চল মোছাফির চল কাফেলায় যাই মদিনায় কামলেওয়ালায়।
৩)ভাসান গানঃ
ষোলটাকা ইউনিয়নে বিভিন্ন গ্রামে ভাসান গানের দল রয়েছে। এই গানের বৈশিষ্ট হলো- তিনটি পালা করে গায়করা গান গেয়ে থাকেন। জন্মপালা, বাঁচার পালা ও মৃত্যুপালা।মৃত্যুপালা হচ্ছে শ্রোতাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। শীতকালে বাড়ী বাড়ী ভাসান গানের আসর বরে থাকে। সারা রাত ধরে এ গানের আসর চলে থাকে। ভাসান গানের মধ্যে বেহুলা স্বামী বিয়োগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে বর্ণনা দেয়া হয়ে থাকে তা শ্রোতার মনকে বিশেষভাবে আলোড়িত করে থাকে। ভাসান গানের কিছু্ অংশ এখানে তুলে ধরা হলোঃ-
‘‘ওকি সাধ আছে হে দিতে লকায়ের বিয়ে
আর কিছু দিন রাখবো ঘরে ধুলো খেলা দিয়ে।’’
৪)শারী গানঃ
এই গান হচ্ছে কর্ম সংগীত। ষোলটাকা ইউনিয়ন অঞ্চলে শারীগানের প্রভাব আজও বিদ্যমান।পাকা ঘরের জলছাদ পেটানো কিংবা কোন ভারী কাজের জোশ সৃষ্টির জন্য শারীগান গাওয়া হয়ে থাকে।
(৫)জারী গানঃ
জারীগান মূলতঃ ইসলামী দৃষ্টিকোন থেকে সৃষ্টি। ষোলটাকা ইউনিয়ন অঞ্চলে মহররমের সময় গায়করা দলবদ্ধ হয়ে বাড়ী বাড়ী জারীগান গেয়ে বেড়ায়। এছাড়াও অনেক জারীগায়ক দল এ অঞ্চলে রয়েছে। জারীগানের কিছু অংশ তুলে ধরা হলোঃ-
‘‘ঈমান যে না আনিবে মক্কার উপরে
গোনাগার হয়ে যাবে দোযখ মাঝারে
আরে রোমের ও শহরে ছিল
৬)ভাটিয়ালী গানঃ
ষোলটাকা ইউনিয়নে গ্রামাঞ্চলে এক সময় ভাটিয়ালী গানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। ইদানিংকালে অনেক কমে গেছে। গরম্নর গাড়ীর গাড়োয়ান, নৌকার মাঝি এবং মাঠের রাখালী ভাটিয়ালী গানের গায়ক হিসেবে আজও এই প্রাচীন লোকসংস্কৃতিকে ধারণ করে রেখেছে।
৭)পালা বা যাত্রাগানঃ
পালা বা যাত্রাগান ষোলটাকা ইউনিয়নে সর্বত্র এখনও অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি লোকসংস্কৃতি হিসেবে বিদ্যমান। রূপবানযাত্রা, ভাসানযাত্রা, ইমামযাত্রা, আসমান সিংহের পালাগান উলেস্নখযোগ্য। শীতকালের পুরো সময় এখানকার গ্রামাঞ্চলে, এমনকি ষোলটাকা ইউনিয়নে যাত্রাগানের আসর বসে থাকে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস